হযরত পাহাড়পুরী রাহ.

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.
95 / 100

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- আমাদের উস্তায ও মুরুব্বী, আমাদের শায়েখ ও মুরশিদ, উস্তাযুল উলামা হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রাহ. গত ২৫ যিলক্বদ ১৪৩৭ হিজরী (মোতাবেক ২৯ আগস্ট ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ) সোমবার দিন প্রায় তিনটায় আখেরাতের ঘরে চলে গেছেন। তিনি চলে গেলেন, আমরা এতীম হলাম। আরও অসংখ্য মানুষ এবং অনেক দ্বীনী প্রতিষ্ঠান এতীম হল। আল্লাহ আমাদের সবার কাফালাত করুন। তিনিই আমাদের কাফিল ও হেফাযতকারী হয়ে যান। আমীন

পাহাড়পুরী হুযুর রাহ. অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং অনেক যোগ্যতা ও সৌন্দর্যের অধিকারি ছিলেন। তাঁর দ্বীনী খেদমতসমূহে অনেক বৈচিত্র্য ছিলো। তাঁর সদকায়ে জারিয়ার তালিকা বেশ দীর্ঘ। তাঁর বহুমুখী কীর্তি ও অবদানের ফিরিস্তিও অনেক লম্বা। তার জীবন ও চরিত্র থেকে গ্রহণ করার মত বিষয় অসংখ্য। তাঁর জীবনের যে দিক শুধু মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতার সাথে সম্পৃক্ত, শুধু এটুকুর ইতিহাসও ছোট নয়।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.

পাহাড়পুরী হুযুর রাহ.-এর জীবন ও কর্ম শুধু এক প্রবন্ধ বা এক কিতাবের বিষয়বস্তু নয়। মূলত এটা অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিস্তৃত একটি বিষয়। এর রয়েছে বহু দিক, বহু শিরোনাম। এর জন্য প্রবন্ধ-নিবন্ধের এক দীর্ঘ সিলসিলার প্রয়োজন। ইনশাআল্লাহ বিভিন্ন সময়ে এই সিলসিলা চলতে থাকবে। আজ শুধু পাঠকবৃন্দের খেদমতে হুযুরের জন্য দুআ ও ঈসালে সাওয়াবের আবেদন জানানোর জন্য কলম ধরেছি।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের মুহতারাম আব্বাজান হযরত মাওলানা আখতারুযযামান পাহাড়পুরী রাহ. ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের ফাযেল। তিনি ছিলেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ.-এর খাস শাগরিদ এবং খাদিম। তিনি ঐ যামানায় দারুল উলূমের তালিবুল ইলম যখন হাকীমুল উম্মত রাহ. হায়াতে ছিলেন। এ জন্য তিনি হযরত থানভী রাহ.-এর যিয়ারত লাভেও ধন্য হয়েছেন। হুযুর তার আব্বাজানের বিস্তারিত স্মৃতিচারণ মাওলানা আবরারুযযামানকে দিয়ে কলমবন্ধ করিয়েছেন। যা আলকাউসার রজব, শা‘বান এবং শাওয়াল ১৪৩৭ হিজরীর তিন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে তিনি তাঁর আম্মাজানের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণও কলমবন্ধ করিয়েছেন, যা আলকাউসার রবিউল আউয়াল ১৪৩১ হিজরী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। তাদের দুজনেরই জীবনীতে আমাদের গ্রহণ করার মত অনেক বিষয় রয়েছে।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের কথা বলার একটি প্রিয় বিষয় ছিল, তাঁর শ্রদ্ধাভাজন আসাতিযা ও পূর্ববর্তী আকাবিরের আলোচনা। সব সময় তিনি এই বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর খুব কম মজলিসই আসাতিযা ও আকাবিরের বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্য, তাঁদের বিভিন্ন ঘটনা ও শিক্ষার আলোচনা থেকে খালি যেতো। এটা একদিকে তো ছিল তাঁর স্বভাবজাত আকর্ষণের বিষয় অন্যদিকে ছিলো তাঁর ফলপ্রসূ তারবিয়াতেরও একটি অংশ। তিনি চাইতেন বর্তমানের তালিবুল ইলম যেন নিজেদেরকে তাদের অতীতের সাথে জুড়ে রাখে এবং নিজেদেরকে পূর্ববর্তীদের রঙে রঙিন করে।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- তার এই ধরনের মজলিসের বিভিন্ন বাণী ও শিক্ষা আমার কাছেও কিছু সংরক্ষিত আছে। আমি মাওলানা আবরারুযযামান (হুযুরের ছাহেবজাদা)-কেও অনুরোধ করেছি, তিনি যেন হুযুরের মূল্যবান সব বাণী ও উক্তি খুব ভালোভাবে গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করেন। আল্লাহর শোকর তিনিও এই বিষয়ে সচেষ্ট ও যতœবান ছিলেন।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- ইনশাআল্লাহ আমরা সময়ে সময়ে হুযুরের সেসব বাণী ও মালফুজাত এবং হুযুরের চিঠিপত্রের সুন্দর ও উপকারী বিষয়গুলো পাঠকের সামনে পেশ করবো।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়েছে তিন মাদরাসায়। প্রথমে পাহাড়পুর ইমদাদুল উলূম মাদরাসায়। এরপর জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগে। এরপর জামিয়া খায়রুল মাদারিস মুলতানে। মুলতানে তিনি এক বছর অবস্থান করেছেন এবং আকাবিরে জামিয়া থেকে ‘ফুনূনের’ দরস গ্রহণ করেছেন। মুলতান যাওয়ার আগে কিছুদিন তিনি হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নূরী রাহ.-এর দরসেও শরীক হয়েছেন এবং মুফতী শফী রাহ. ও অন্যান্য আকাবিরের সাক্ষাৎ ও যিয়ারত লাভ করেছেন। মুলতানে অবস্থানকালে তিনি লাহোরেও সফর করেছিলেন এবং হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রাহ.সহ সেখানকার আরো কয়েকজন আকাবিরের যিয়ারত ও ছোহবত লাভ করেছেন।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের শিক্ষকতা জীবনের বড় ও  গুরুত্বপূর্ণ অংশ অতিবাহিত হয়েছে মাদরাসায়ে নূরিয়া আশরাফাবাদে। সেখানে তিনি তাঁর উস্তায ও মুরুব্বী শায়খ ও মুরশিদ এবং তাঁর মুহাতারাম শ্বশুর হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর দীর্ঘ ছোহবত পেয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর মমতার ছায়া এবং স্বস্নেহে তত্ত্বাবধান লাভ করেছেন। এই ধারা রমযানুল মুবারক ১৪০৭ হিজরীতে হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর ইন্তিকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এটা তাঁর জীবনের সেই সোনালী অধ্যায়, যাকে তিনি সারা জীবন নিজের সৌভাগ্য ও প্রাপ্তির সম্বল বলে মনে করতেন। তাঁর জীবনের এই অধ্যায়ের ইতিহাস যদি লেখা হয় তাহলে শুধু এর জন্যই একটি আলাদা গ্রন্থ প্রয়োজন।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- নূরিয়ার যামানায় যারা তাঁর কাছ থেকে তালীম ও তারবিয়াত হাসিল করেছেন তাদের সংখ্যা কয়েক হাজার। তাদের মধ্যে আমাদের ইলম মোতাবেক বিভিন্ন দিক বিচারে সবার শীর্ষে হলেন মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুমের শাখছিয়্যাত। যাকে খোদ পাহাড়পুরী হুযুর রাহ. ‘আদীব হুযুর’ খেতাব দিয়েছেন। পাহাড়পুরী হুযুরের সাথে আদীব হুযুরের সম্পর্কের ধরন কম-বেশি অনুমান করা যাবে আদীব হুযুরের সেসব বিবরণ থেকে যেগুলো ‘বায়তুল্লাহর মুসাফির’-এ তাঁর প্রসঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে এসেছে। এর কিছু নমুনা পাওয়া যাবে তাঁর সফরনামা ‘এখনো আছে একটি প্রদীপ’-এ, যা আলকাউসার জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩২ হিজরী/মে ২০১১-এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁর আরেক সফরনামা ‘সেই পায়ের একটুখানি ধূলোর জন্য’ যা আলকাউসার জুমাদাল আখিরাহ ও রজব ১৪৩৫ হিজরীর দুই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- ‘আততরীকু ইলাল কুরআনিল কারীম’ প্রথম খণ্ডের শুরুতে পাহাড়পুরী হুযুরের প্রদত্ত দুআ থেকেও কিছুটা অনুমান করা যাবে। আমরা পাহাড়পুরী হুযুরকে সবসময় দেখেছি তাঁর এই শাগরেদের সপ্রশংস আলোচনা করতে। মাদরাসাতুল মাদীনাহ, মাদানী নেসাব, মাদানী মঞ্জিল এগুলো সব পাহাড়পুরী হুযুরেরই দেওয়া নাম। মাদানী নেসাবের একটি কিতাবের দরস দিতে আমি নিজে তাঁকে দেখেছি। একজন তালিবুল ইলমের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, তার উস্তায তার কিতাবের দরস দিয়েছেন!!

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- থেকে শা‘বান ১৪১৬ হিজরী পর্যন্ত তিনি জামিয়া মুহাম্মাদিয়া, মুহাম্মাদপুরে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। ঐ সময় শেষ তিন বছর আমার বড় ভাইজান হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহও সেখানে তাদরীসের খেদমত করেছেন। শাওয়াল ১৪১৬ হিজরী (মোতাবেক মার্চ ১৯৯৬) সনে যখন ‘মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র সূচনা হলো, তখন বিশেষভাবে ভাইজানেরই অনুরোধে পাহাড়পুরী হুযুর রাহ. মারকাযুদ দাওয়াহ্র তত্ত্বাবধানের যিম্মাদারী গ্রহণ করেন। যতদিন সুস্থ ছিলেন, দেহে শক্তি ছিলো ততদিন এ দায়িত্ব তিনি সর্বসুন্দরভাবে আঞ্জাম দিয়ে গিয়েছেন।

মুহাররম ১৪২৬ হিজরীতে মাসিক আলকাউসার তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রা শুরু করে। আফসোস, দৃশ্যত আজ এই সুশীতল ছায়া আমাদের থেকে সরে গেছে। আমরা নিজেরাও দুআ করছি, পাঠকের কাছেও দুআর আবেদন করছি, আল্লাহ তাআলা যেন আমাদেরকে পাহাড়পুরী হুযুর এবং অন্যান্য আকাবির ও সালাফে সালেহীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র মত ও পথ এবং সিরাতে মুস্তাকীমের উপর অটল অবিচল থাকার তাওফীক দান করেন। আমীন

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের সর্বশেষ স্মৃতি এবং শেষ জীবনের একটি বড় কীর্তি হলো তার প্রতিষ্ঠিত আল মারকাযুল ইলমী। এটা তো ছিলো যেন তার রূহ। আমরা আশা করবো, হুযুরের বড় ছাহেবজাদা মাওলানা আশরাফুয যামান, যার কাছে পাহাড়পুরী হুযুর এই প্রতিষ্ঠানের যিম্মাদারী ন্যস্ত করেছেন, তিনি এর বর্ণিল বৃত্তান্ত ও ইতিহাস সম্পর্কে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনা করবেন। হুযুরকে যারা ভালোবাসেন, মুহাব্বত করেন তাদের কাছে আমার দরখাস্ত, তারা যেন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক কায়েম রাখাকে নিজেদের সৌভাগ্যের সম্বল মনে করেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, এ আমাদের উপর হুযুরের একটি হক।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের জন্ম ২৬ শ্রাবণ ১৩৫৫ বাংলা, ১০ আগস্ট ১৯৪৮ বুধবার ভোর রাতে। জীবনের শেষ বছর তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী এবং পূর্ণ খামোশ হয়ে ছিলেন। এর আগের তিন চার বছরও কঠিন অসুস্থতার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়েছে। সম্ভবত এসবের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলা তার বাতেনী মরতবা বেশি থেকে বেশি বুলন্দ করতে থেকেছেন। আল্লাহ পাকের খাস তাওফীকে মাওলানা আশরাফুয যামান ও মাওলানা আবরারুয যামান দুই ভাই পূর্ণ সৌভাগ্যের অনুভূতি নিয়ে পরম যতœ ও মমতার সাথে অসুস্থ আব্বাজানের খেদমত করে গেছেন। তাদের সাথে কিছু তালিবুল ইলম ভাইও হুযুরের খেদমতে শরীক ছিলেন। বিশেষ করে শেষ বছর তো কয়েক তালিবুল ইলম লাগাতার নিরবচ্ছিন্নভাবে হুযুরের খেদমতে লেগে ছিলেন।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- এই দুনো ভাই এবং সে সকল সাথীরা সবাই আমাদের মুহসিন। আমাদের দায়িত্ব ছিলো  হুযুরের খেদমতে থাকা। কিন্তু আমাদের দ্বারা তা হয়নি। এরা সবাই হাসিমুখে পরম যতœ ও মমতার সাথে আমাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে আমাদের পক্ষ থেকে ভরপুর জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- কোন সন্দেহ নেই যে, ইনশাআল্লাহ তাদের সবার ভবিষ্যত বড়ই উজ্জ্বল!

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হযরতের অসুস্থতার দীর্ঘ সময়ে দেশ-বিদেশের অনেক চিকিৎসক আন্তরিকতার সাথে সেবা দিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে বারডেম ও খিদমাহ হাসপাতালের চিকিৎসকবৃন্দের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- শেষ দিকে খিদমাহ হাসপাতালের অবদান সবচেয়ে বেশি। আল্লাহ তাআলা খিদমাহ হাসপাতালকে কবুল করুন এবং আরো বেশি থেকে বেশি উন্নতি দান করুন।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের তৃতীয় ছেলে মাহমুদুল হাসান মাদরাসাতুল মাদীনাহ আশরাফাবাদে সপ্তম বর্ষের তালিবুল ইলম। আল্লাহ তাকে সুস্থ ও নিরাপদ, কল্যাণ ও সফলতার যিন্দেগী নসীব করুন। হুযুরের সব মেয়েরাই মাশাআল্লাহ আলেমা। কয়েকজন হাফেজাও। আল্লাহ প্রত্যেককে ঈমান ও আফিয়াতের যিন্দেগী নসীব করুন এবং নিজেদের পূর্ববর্তীদের পথে চলার তাওফীক দান করুন এবং সুস্থ ও নিরাপদ রেখে তাদের আম্মাজানের ছায়া পুরো পরিবারের উপর দীর্ঘ জীবন বাকি রাখুন। আমীন

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হুযুরের ইন্তিকাল শুধু একটি পরিবার বা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘হাদিসা’ নয়। বরং পুরো উম্মতের জন্যই ‘হাদিসা’। প্রত্যেকের জন্যই অনেক বড় ‘হাদিসা’। এই মুহূর্তে সবাই সান্ত¡না ও সমবেদনার মুখাপেক্ষী। তারপরও তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন সমবেদনার বেশি হকদার। আমরা তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি-

أحسن الله عزاءكم، وعظم أجركم، وغفر لميتكم .

إن لله ما أخذ وله ما أعطى وكل شيء عنده بمقدار.

العين تدمع والقلب يحزن ولا نقول إلا ما يرضى ربنا وإنا بفراقك يا شيخ لمحزونون.

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- সম্মানিত পাঠকদের কাছে দরখাস্ত যে, যার পক্ষে যেভাবে সম্ভব, যার জন্য যেটা সহজ, সবাই আমরা পাহাড়পুরী হুযুরের জন্য ঈসালে সওয়াব করতে থাকি এবং নিজেদের সবসময়ের দুআয় হুযুর, হুযুরের খান্দান এবং হুযুরের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা স্মরণ রাখি।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- আজ এ ভূমিকার মাধ্যমেই লেখা শেষ করছি। আল্লাহ তাওফীক দিলে ইনশাআল্লাহুল আযীয হুযুরের জীবনের উপর বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে। নিজেরই ফায়দার জন্য, নিজের সন্তান ও শাগরেদদেরকে সনদের সিলসিলার পূর্ববর্তী কড়িটির সাথে যুক্ত করার জন্য।

মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রাহ.-কে যেমন দেখেছি ও শুনেছি

প্রফেসর গিয়াসুদ্দীন আহমদ

মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রাহ. এমন একটি নাম, যে নামের সাথে নেকীর পাহাড়ের একটি ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যখনই কারো মুখে তাঁর নাম শুনি অথবা কারো লেখায় তাঁর নামের উল্লেখ দেখি, তখনই নেকী ও পুণ্যের একটি আমেজ উপলব্ধি করি। সেইসাথে একজন ভালো মানুষের পরিচয়দানে সেই হাদীসখানি স্মরণ করি, যাতে বলা হয়েছে-

أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِخِيَارِكُمْ  قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: الَّذِينَ إِذَا رُؤُوا، ذُكِرَ اللهُ تَعَالَى  .

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- আমি কি তোমাদের জানাব না তোমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো সম্পর্কে? সকলে আরজ করলেন, অবশ্যই বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন, যাদের দেখলে আল্লাহর কথা মনে পড়ে।  -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৭৫৯৯; আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৩২৩

অন্যস্থানে এসেছে-

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ : قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَيُّ جُلَسَائِنَا خَيْرٌ؟ قَالَ: مَنْ ذَكَّرَكُمْ بِاللَّهِ رُؤْيتَهُ، وَزَادَ فِي عِلْمِكُمْ مَنْطِقَهُ، وَذَكَّرَكُمْ بِالْآخِرَةِ عَمَلُهُ.

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বলা হল, আল্লাহর রাসূল! আমাদের কোনো সঙ্গীরা শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, যাদের দর্শনে আল্লাহর স্মরণ জাগে, যাদের কথায় জ্ঞান বাড়ে এবং যাদের কর্ম তোমাদের আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯০০০

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- মাওলানার স্মৃতিবিজড়িত কিছু লিখতে আজ আমি নিশ্চল, নিস্তব্ধ। তিনি ছিলেন আমার এক খাঁটি ও আন্তরিক বন্ধু। আমাদের শায়েখ হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর জামাতা। আর আমি শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ.-এর জামাতা। সম্পর্ক খুবই নিকটবর্তী।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- নিজ শায়েখের প্রতি মাওলানার শ্রদ্ধা ও মুহাব্বত ছিল অপরিসীম। সেই সাথে তাঁর মধ্যে সুন্নতের মুহাব্বতও ছিল অপরিমেয়। এ দুটি জিনিসের উপস্থিতি মাওলানার জীবনকে করে তুলেছিল মহীয়ান।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- শায়েখের মুহাব্বত এবং সুন্নতের অনুসরণ

নিজ শায়েখের প্রতি মাওলানার ছিল অপূর্ব শ্রদ্ধা, ভক্তি ও মুহাব্বত। এরই ফলে তিনি শায়েখের সঙ্গে পবিত্র হজ্বে যাওয়ার সুযোগ পান। আর এর সাথে শায়েখের শর্ত ছিল হজ্বের সফরে পূর্ণ বুখারী শরীফ তাঁর নিকট অধ্যয়ন করতে হবে। অবশ্য সফর ছিল চার মাসের। শিষ্যের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষণ করলেই না এরকম শর্ত  করা যেতে পারে। এ ছিল ১৯৭৫ সালের কথা, যখন হযরত বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে পড়েননি।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- হযরত শায়েখ রাহ. মাওলানার ইলম ও এখলাসে নিদারুণ মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজ মাদরাসা নূরিয়াতে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করার পূর্বে পাকিস্তান থেকে ডেকে পাঠাতে পত্রে লিখেছিলেন-

آپ جیسے مخلصین کا نوریہ محتاج ہے اور رہیگا، میرا خط ملتے ہی فورا آجائے.

(আপনাদের মত মুখলিস লোকদের জন্য মাদরাসায়ে নূরিয়া মুখাপেক্ষী আছে এবং থাকবে। আমার পত্র পাওয়া মাত্রই তৎক্ষণাৎ চলে আসুন।) পাহাড়পুরী রাহ. হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘তখন বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র বিশ দিন বাকী। অপর দিকে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের জরুরি তাগিদ দেয়া চিঠি। …পরামর্শের জন্য স্বীয় উস্তায আল্লামা শরীফ কাশ্মিরী রাহ.-এর কাছে সব খুলে বললাম এবং তাঁর হাতে চিঠিটি তুলে দিলাম। চিঠিটি পড়ে তিনি বললেন,

حضرت حافظجی حضور تمکو اتنی محبت کی نظرسے دیکھتے ہیں، تمھیں دیر نہ کرنی چاہئے.

(হযরত হাফেজ্জী হুযুর তোমাকে অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন। তাই তোমার দেরি না করা উচিত।)[1]

এ তো গেল শায়েখের প্রতি মাওলানার শ্রদ্ধা-ভক্তি ও মুহাব্বতের কথা এবং মাওলানার প্রতিও শায়েখের স্নেহ-মুহাব্বতের কথা।  এখন রইল সুন্নতের প্রতি মাওলানার আন্তরিক মুহাব্বতের কথা। একদিন দাওয়াতুল হকের এক সভায় দাওয়াতী মেহমান হিসেবে তিনি ওয়ায করছিলেন। মাওলানা সুন্নতের মুহাব্বতের বিষয় আলোচনা করছিলেন, আর শ্রোতারা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাঁর অতি মূল্যবান তাকরীর শুনছিলেন। বাস্তব জীবনে সুন্নতের অনুসরণে যে কী শান্তি মাওলানা তাঁর জীবন থেকেই এর উদাহরণ পেশ করছিলেন। বলছিলেন, ‘আলহামদু লিল্লাহ! আমার বিবাহের সবকিছু সুন্নত মোতাবেক হওয়ায় আমাদের জীবনে কত শান্তি। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমহর ধরা হয়েছিল, ফলে বিয়ের ব্যাপারটা আমার উপর বোঝা স্বরূপ হয়নি।’ পবিত্র হাদীসে যে রয়েছে, যে বিবাহে খরচ যত কম, তাতে বরকত তত বেশি- এরই বাস্তবতা তাঁর বিয়েতে কার্যকর হয়েছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।

হযরত পাহাড়পুরী রাহ.:- জানতে পেরেছি তিনি নিজ সন্তানদের (যাদের সংখ্যা মাশাআল্লাহ অনেক) বিয়ে শাদী অত্যন্ত সাদেগীর সাথে পূর্ণ সুন্নত মোতাবেক আঞ্জাম দিয়েছেন। তাছাড়া যুহদ, তাকওয়া ও সকলের হক আদায়, যিম্মাদারী পালনে যথাযথ আমানত রক্ষা, আদব এবং তাওয়াযুসহ সুন্নতে নববীয়্যার বড় বড় দিকগুলোর অনুশীলন তার যিন্দেগীতে ছিল একটি স্পষ্ট বিষয়।

মাওলানার মধ্যে শায়েখের মুহাব্বত ও সুন্নতের অনুসরণ এই উভয় জিনিসের বাস্তবতা উপলব্ধি করে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ.-এর একটি বাণীর প্রতি অধমের মন ধাবিত হচ্ছে। তাঁর এই বাণী হযরত হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাকীদের সাথে উদ্ধৃত করতেন। বাণীটি এই- ‘(কারো জীবনে) শায়েখের মুহাব্বত ও সুন্নতের অনুসরণ হতে থাকলে লাখো গহিন অন্ধকারও অন্ধকার নয়; বরং তা সবই নূর। আর এই দুটি জিনিসের (অর্থাৎ শায়েখের মুহাব্বত ও সুন্নতের অনুসরণ) কোনো একটিরও অভাব থাকলে লাখো নূরও অন্ধকারই বটে’। হযরত থানভী রাহ. হযরত হাফেয শিরাজী রাহ.-এর এই কবিতাও প্রায়ই উদ্ধৃত করতেন-

در طریقت ہر چہ پیش سالک آید خیراوست + بر صراط مستقیم اۓ دل کسے گمراہ نیست.

‘তরীকতের মধ্যে সালেক যা কিছুই অর্থাৎ যে হালতেরই সম্মুখীন হয়, তার জন্য তাই উত্তম। কেননা সীরাতে মুসতাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত অন্তর পথভ্রষ্ট নয়’।

তবে হযরত হাকীমুল উম্মত এ-ও বলতেন, এতে হালতের ‘আগমন’ ও ‘সিরাতে মুসতাকীম’ শব্দ দুটির শর্ত আছে। প্রথম শর্তটির অর্থ হচ্ছে, সেই হালত নিজ থেকে আসে, টেনে আনা হয় না। অর্থাৎ তা গায়রে এখতেয়ারী। তাই বাহ্যত শত কষ্ট হলেও তার কোনো কিছুই দোষণীয় নয়। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, সীরাতে মুসতাকীমের উপর মজবুত থাকা। কবিতার মর্মার্থ এই যে, সীরাতে মুসতাকীমের উপর মজবুতির সঙ্গে কায়েম থাকলে প্রিয় বা অপ্রিয় গায়রে এখতেয়ারী যে কোনো হালই আসুক না কেন তা সালেকের জন্য শুভই বটে।

বলা বাহুল্য, মাওলানার জীবনে উল্লিখিত গুণাবলি আমরা (তাঁর দোস্ত-আহবাব ও তার সঙ্গে সম্পর্কধারীগণ) বিলক্ষণ দেখতে পেয়েছি। তিনি সারাটি জীবন শায়েখের মুহাব্বতে ও সুন্নতের অনুসরণে ছিলেন তৎপর, একনিষ্ঠ।

আপন শায়েখ ও উস্তায হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর জীবনের অসমাপ্ত কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য পাহাড়পুরী রাহ. নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। হাফেজ্জী হুযুরের মহৎ এরাদা ছিল, তিনি ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রামে আটষট্টি হাজার মক্তব-মাদরাসা স্থাপন করবেন। আর রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়াও তিনি এ চেষ্টায় অদমিত ছিলেন। যেমন তিনি দেশে অনেক মাদরাসা-মসজিদ করেছিলেনও। মাওলানা পাহাড়পুরী রাহ. আপন শায়েখের সঙ্গে এমন কাজে শরীকও ছিলেন। আর শরীক থাকার ফলে তার প্রশিক্ষণও হচ্ছিল।

শায়েখের ইন্তেকালের পর তিনি কোমর বেঁধে লেগেছিলেন শায়েখের অসমাপ্ত কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য। কিছু কাজ আঞ্জাম দিয়েওছিলেন। ইতিমধ্যে তার দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করে। এদিকে শায়েখের অসমাপ্ত আরো বহু কাজ বাকি থেকে যায়। ফলে তিনি একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। দৃষ্টিশক্তি হারানোর যে কী ফযিলত, মাওলানা তা বিলক্ষণ জানতেন। এ-ও জানতেন যে, আমাদের আকাবিরের মধ্যে কেউ কেউ উক্ত ফযীলতের অধিকারীও হয়েছেন (আল্লাহ তাআলার প্রতি আমাদের হুসনে যন এই যে, মাওলানাও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।) কিন্তু তাঁর ভেঙ্গে পড়ার কারণ এই ছিল যে, আহা! আমি তো আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শায়েখের অসমাপ্ত কাজগুলি শেষ করে যেতে পারলাম না।

শুনে অবাক হতে হয় যে, দৃষ্টিশক্তি একেবারে হারিয়ে ফেলার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত মাওলানা লালমাটিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস হিসেবে বুখারী শরীফের দরস দিতে থাকেন। সেইসাথে অপরাপর ইলমী প্রতিষ্ঠানেরও খেদমত করতে থাকেন। মাশাআল্লাহ, মাওলানার দুই ছেলে বড় আলেম হয়েছেন। তারা পিতার আখেরী কাজকর্মে সহযোগিতা করছিলেন। আর এখন তো শ্রদ্ধেয় পিতার পর সেসব কাজের কাণ্ডারি তাদেরকেই হতে হচ্ছে। তাদের বড়জন মাওলানা আশরাফুজ্জামান, দ্বিতীয়জন মাওলানা আবরারুজ্জামান। তাদের জন্য সকলে দুআ করবেন। তারা যেন পিতার যথোপযুক্ত সন্তান হিসেবে পিতার রেখে যাওয়া কাজগুলি আঞ্জাম দিতে পারেন।

মাওলানা রাহ.-এর হাতে গড়া, তাঁর হাতে তালীম ও তরবিয়াত পাওয়া, তাঁর বিশিষ্ট খলীফা যারা আছেন তারা যেন তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলি দেখেন এবং আঞ্জাম দেন- এ-ই আমার প্রত্যাশা।  


[1] ১ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাওলানার লিখিত একটি পুস্তকে তাঁর প্রতি শায়েখের স্নেহ মুহাব্বতের কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন ‘আামার জীবন হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর যে কী পরিমান স্নেহ, মুহাব্বত ও আস্থায় ধন্য হয়েছে তা বলে বুঝানো যাবে না, লিখেও শেষ করা যাবে না। অজস্র ঘটনা রয়েছে।’