কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা

আল কুরআনের বর্ণনায় দিন ও রাত
90 / 100

অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: এ দেশের ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগারের এক সুগভীর চক্রান্ত নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এ চক্রান্তের নেটওয়ার্ক সুবিস্তৃত ও সুসংগঠিত। আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তি হচ্ছে এ চক্রান্তের মূল। তাদের বৃত্তিভোগী এজেন্টরা সুকৌশলে কুর’আন ও হাদীসের শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। এসব এজেন্টরা সরকারের অভ্যন্তরে, বিরোধী দলে, প্রশাসনে, বেসরকারী সেবা সংস্থায়, সংবাদপত্রে ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমানভাবে সক্রিয় থেকে অভিন্ন ভাষায় কথা বলছেন এবং একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নানা অজুহাত খাড়া করে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- এনজিও সমর্থিত বেশ ক‘টি সংবাদপত্র তিলকে তাল করে এবং তালগোল পাকিয়ে তথ্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, যাতে জনমত বিভ্রান্ত হচ্ছে। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এনজিওগুলো প্রকৃত অর্থে কোনো সরকারেরই বন্ধু নয়; সরকারকে ব্যবহার করে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাই হচ্ছে তাদের কর্মকৌশল। ভোলার গ্রীন ক্রিসেন্ট এনজিও প্রতিষ্ঠানকে কওমী মাদরাসা নামে প্রতিষ্ঠিত করার যে আয়োজন চলেছিল তা ছিল একই ষড়যন্ত্রের অংশ বিশেষ।

ব্রিটেনের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত গ্রীন ক্রিসেন্ট এনজিও কার্যালয় যে আদৌ কোন কওমী মাদরাসা নয় এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। সরকার, সরকারী এজেন্সীসমূহ যে কোন দিন, যে কোন সময়, বাংলাদেশের যে কোন কওমী মাদরাসা পরিদর্শন করতে পারেন, তাদের সার্বিক কর্মকান্ডও মনিটর করতে পারেন। কেবল এক শ্রেণীর বিদ্বিষ্ট সংবাদপত্রের কল্পিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কওমী মাদ্রাসাকে টার্গেট করলে সরকার ও জনগণের মধ্যে অহেতুক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাবে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:-১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর পরই উত্তর ভারতের দেওবন্দ কেন্দ্রিক যে দ্বীনি শিক্ষাধারা চালু হয়েছিল এখন তা এ উপমহাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা নামে বেশ সুখ্যাতি লাভ করে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই এ শিক্ষা ধারার উদ্দেশ্য ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার, জান্নাতমুখী জনগোষ্ঠী তৈরীকরণ, সামাজিক কুসংস্কার ও কুপমন্ডুকতা বিদূরিকরণ ও ব্যক্তি চরিত্র সংশোধন। প্রচলিত ও দলীয় রাজনীতির প্রভাব বলয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে কওমী মাদরাসার পরিচালক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফিক্হ, ভাষা-সাহিত্য, ক্লাসিক্যাল দর্শনের শিক্ষা ও খিদমত সুচারূরূপে আঞ্জাম দিয়ে আসছেন শত বছর ধরে। বাংলাদেশের বিগত ৩৮ বছরের ইতিহাসে কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোন কর্মকান্ডে বা সন্ত্রাসী কোন তৎপরতার সাথে জড়িত থাকার কোন প্রমাণ নেই।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- কওমী মাদরাসা শিক্ষার সুদীর্ঘ ইতিহাসে খুন-খারাবী, টেন্ডার বা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের ন্যুনতম কোন নজির নেই। এসব মাদরাসায় রাজনীতিভিত্তিক কোন ছাত্র সংসদ নেই এবং ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততাও একপ্রকার নিষিদ্ধ। ফলে এখানে বিরাজ করে রাজনীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সুষ্ঠু শিক্ষার শান্ত পরিবেশ। সুতরাং মাদরাসায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পরিকল্পনার প্রশ্নই অবান্তর। আর সন্ত্রাসের আওতায় পড়ে এমন ঘটনা কোথাও ঘটলে তা নিশ্চিতভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই দায়ী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ যদি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে এবং অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের চেষ্টা চালায়, সে দায় কোন মাদরাসা নিতে পারে না।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- এ ক্ষেত্রে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বা সব মাদরাসাকে ঢালাওভাবে দায়ী করাও যুক্তি সংগত নয়। সত্যিকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ অবদমনে সরকারকে সহযোগিতা করতে এ দেশের ওলামা-মাশায়েখগণ সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত বলেই বার বার প্রমাণিত। স্মর্তব্য যে, কওমী মাদরাসারসমূহ পরিচালিত হয় মূলত এ দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অর্থায়নে; সরকারী কোন অনুদান তাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে গ্রহণ করেন না। এদেশের কোটি কোটি জনগণের সাথে কওমী মাদরাসার প্রাণের সম্পর্ক বিদ্যমান। কওমী মাদরাসা থেকে পাশ করা ছাত্ররা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরাপের সরকারী-বেসরকারী পদে, মসজিদ, মাদরাসা পরিচালনায়, দাওয়াত-তাবলীগে, সমাজ সংস্কারে, নিরক্ষরতা দূরিকরণে এবং শিক্ষা বিস্তারে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখে চলেছেন। কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা ঈমানী চেতনা, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও দেশপ্রেমের আদর্শে প্রবলভাবে উদ্দীপিত। দাওয়াতী মেযাজ সবার মধ্যে কমবেশী ক্রিয়াশীল।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- আমার ব্যক্তিগত প্রবল অনুমান যে, বর্তমান সরকার ও কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৃতীয় একটি শক্তি সক্রিয়। প্রকাশ্য ও নেপথ্য চক্রান্তের মূল হোতা হচ্ছে এক শ্রেণীর এনজিও। তারা সমান্তরাল একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় এবং বিনষ্ট করতে চায় সরকারের ভাবমূর্তি, কারণ এনজিওগুলো এদেশের এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত হলেও তাদের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ইহুদি-খ্রিষ্টান-সাম্রাজ্যবাদী অক্ষ শক্তি।

এ দেশের মানুষ ভালভাবে জানেন যে, মাদরাসায় চরিত্রবান ও আদর্শ ছাত্র তৈরী হয়। মাদ্রাসায় শিক্ষার সাথে দীক্ষার (তারবিয়ত) ব্যবস্থা আছে, যা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকায় কোন ছাত্রসংসদ নেই। ফলে সংগত কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে হানাহানিও নেই। রাজনৈতিক হাঙ্গামা বা সন্ত্রাসের কারণে এদেশের কোন মাদরাসা একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি। অথচ এদেশের হাতেগোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কমবেশি সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মিনি ক্যান্টনমেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন সময় বন্ধ থাকায় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট সৃষ্টি এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- স্বাধীনতার পর থেকে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হাজারো টগবগে মেধাবী তরুণ নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ধর্ষণ জাতির কপালে কলংকের তিলক রেখা অংকিত করেছে। সামপ্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যেভাবে অস্ত্রের মহড়া চললো এবং প্রাণহানি ঘটলো তাতে পুরো জাতি উদ্বিগ্ন হয়েছে।

এতদসত্ত্বেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কোন দাবি কেউ উঠায়টনি। তাই সাজানো কিছু নাটক, পাতানো কিছু খেলা ও কল্পিত তথ্যকে ভিত্তি করে কিংবা অতি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনার সূত্র ধরে মাদরাসা বন্ধের দাবি তোলা রীতিমত হাস্যকর ও উদ্ভট। এদেশে দ্বীনি শিক্ষার বিরুদ্ধে যে চক্রটি সক্রিয়, বিশেষত এনজিও গোষ্ঠী, তারা তাদের এজেন্টদের সহায়তায় এবং নিজস্ব সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারকে প্ররোচিত করছে, যাতে সরকার মাদরাসার বিরুদ্ধে দমননীতি জোরদার করে এবং নেতিবাচক সিদ্ধান- গ্রহণ করে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে বা নীতি নির্ধারক মহলে এনজিও সমর্থক যেমন আছেন, তেমনি দ্বীনি শিক্ষাকে মোহাব্বত করেন এমন ব্যক্তিরও আশা করি অভাব নেই। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার প্রকৃত সত্য অনুধাবন এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেন্টিমেন্ট ও আবেগের দিকে লক্ষ্য রেখে দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষার পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। কারণ এটা বুমেরাং হওয়ার আশংকা আছে। দ্বীনি শিক্ষার বিকাশধারায় সরকার যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন অবদান রাখতে পারেন, তাহলে এটা হবে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদীদেরকে মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রাখার সুযোগ দিলে পরিস্থিতি আক্ষেপ, ক্ষোভ ও বেদনার মিলিত সংকট মোহনায় চলে যেতে পারে, এমন আশংকা অমূলক নয়।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ইস্যুর মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে অকার্যকর এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করার খেলায় মেতে উঠেছে, এ কথাটি সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতার চেতনাকে দৃঢ়ভাবে লালনের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাই সত্যিকারের মানুষ গড়ে তোলার আদর্শ শিক্ষাঙ্গন। মাদরাসাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ব পালন, ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়া হয়।

নৈতিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে সুনাগরিক উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসাগুলোর রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। বর্তমানে কওমী মাদরাসার ওপর যে সব বহুমূখি বিষোদগার হচ্ছে তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন গোটা দেশ জুড়ে প্রতিনিধিত্বশীল কওমী মাদরাসার একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যে প্লাটফরমের মাধ্যমে নিয়মিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সংলাপ, কর্মশালা করে নিজেদের অবস্থান জনসমক্ষে তুলে ধরা যেতে পারে। এতে এ বিষয়ক অজ্ঞতা ও বিভ্রানি- যেমন দূর হবে তেমনি আন্তরিকতা বাড়বে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- সামাজিক ও সেবামূলক বিভিন্ন প্রোগ্রামে মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের সংযুক্তি বাড়াতে হবে। স্থানীয় ছোট ছোট বৈধ উপলক্ষগুলোতেও মাদরাসার পক্ষ থেকে ইতিবাচক অংশগ্রহণ বজায় রাখার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। আধুনিক শিক্ষিত ও সাধারণ জনগণকে এ সংগঠনের মাধ্যমে অথবা ব্যক্তিগত যোগাযোগ দ্বারা কওমী মাদরাসার প্রতি আরো সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলা যাবে। সুচিন্তিত পন্থায় এসব প্রোগ্রামের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন স্বার্থান্বেষী মহল রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হবে।

মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রকার যোগাযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং বাড়িয়ে তুলতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে বহু দ্বীন দরদী ব্যক্তি আছেন যারা আলেম-উলামা ও মাদ্রাসাকে মুহাব্বত করেন; কিন্তু যোগাযোগের অভাবে গ্যাপ তৈরী হয়ে আছে। এ গ্যাপ যত তাড়াতাড়ি দূর করা সম্ভব হবে ততই মঙ্গল। ইতিবাচক সব কাজ ও লক্ষ্যের সঙ্গে মিডিয়াও কিছুটা অনূকুলে থাকলে আগ্রাসীদের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া ইনশাআল্লাহ কোনো কঠিন ব্যাপার হবে না

কওমী মাদরাসা সূচনার ইতিহাস / কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ : কিছু কথকতা


কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- দারুল উলুম দেওবন্দ” ভারত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও সুপ্রাচীন ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিগত শতাব্দীর মুসলিম বিশ্বে খ্যাতনামা মনীষীবর্গের জন্মদাতা। উম্মাহর ইলম ও আমলের পথে সফল রাহবার। এই মাদারে ইলমীর পরিচয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ভারতবর্ষে তার অবদান কী তা জানতে হলে আমাদের কে ফিরে তাকাতে হবে প্রায় দেড় শতাব্দী পেছনে। কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল মুসলমানদের পক্ষ থেকে হিন্দুস্তানকে ফিরিঙ্গী আগ্রাসন মুক্ত করার সর্বশেষ সশস্ত্র পদক্ষেপ। এই আন্দোলনের মাধ্যমে উপনেবেশিক শক্তি এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, মুসলিম জাতি কোন অবস্থাতেই গোলামীর জিন্দেগী বরন করে নিতে সম্মত হবে না।

তাই তারা কর্ম কৌশল পরিবর্তন করল। যে পিঙ্গল বর্ণের নরপিশাচ হিন্দুস্তানের মাটিতে লক্ষ মুসলমানের বুকের তাজা রক্তে খুনের দরিয়া রচনা করেছে, তারাই আবার সর্বসাধারনের কল্যাণকামীর মুখোশ পরে তাদের সামনে হাজির হল। উদ্দেশ্য ছিল, ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিংবা গায়ের জোরে যে কওমকে দমন করা যায় না, ধীরে ধীরে তাদের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনা। যেন তারা ধর্মীয় অনুশাসন, স্বকীয় সভ্যতা ও দীপ্তিমান অতীতকে ভুলে গিয়ে অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে সতন্ত্র জাতি হিসেবে মূল্যায়ন করতে না পারে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- এই হীন উদ্দেশ্য সফল করার সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। এবং এর মাধ্যমে তাদের দিল-দেমাগে পাশ্চাতের চতুর্মূখী প্রভাব বদ্ধমূল করা। যেন এতে প্রভাবিত হয়ে তারা নিজ বিবেক দিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ লক্ষকে সামনে রেখে ‘লর্ড ম্যাকল‘ এদেশের মানুষের জন্য এক নতুন শিক্ষানীতির সুপারিশ করেন। তা বাস্তবায়নের লক্ষে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। তাতে ভারতবর্ষের জাতীয় শিক্ষানীতি তথা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ন্যাক্কারজনক ভাবে উপহাস করা হয়। এবং ওলামায়ে কেরামের উপর ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করা হয় পরিশেষে তিনি স্পষ্ঠ ভাষায় লেখেন, ” এখন আমাদের কর্তব্য হল, এমন একদল লোক তৈরি করা যারা আমাদের অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসী ও আমাদের মাঝে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করবে।

যারা রক্ত ও বর্ণে হিন্দুস্তানী হলেও চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন ও চারিত্রিক দৃষ্টিকোন থেকে হবে ইংরেজ্”। কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- দূরদর্শী ওলামায়ে কেরাম এই সুদূর প্রসারী চক্রান্ত ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে বেখবর ছিলেন না। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এখেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের দ্বীন-ঈমান রক্ষার্থে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভিবষ্যতে তারা সতন্ত্রজাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না।

কয়েক খান্দান পরে হয়তো ইসলাম ও তার মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে সচেতন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই তাঁরাও সম্মুখ সমরে লড়াই পরিহার করতঃ কার্যপদ্ধততে পরিবর্তন আনায়নে সচেষ্ট হলেন। নব উদ্ভুত শিক্ষানীতির ধ্বংসের হাত থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষার একটি মাত্র পথ তখন খোলা ছিল। ‘ দারুল উলূম ‘ প্রতিষ্ঠার প্রায়াসে তাঁরা সে দিকেই অগ্রসর হয়েছিলেন। কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী, রশিদ আদম্মদ হাঙ্গুহী, হাজী আবেদ হুসাইন (রহঃ) ১৮৫৮ সালের জিহাদে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

এমন কি উত্তর প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। এ কারনে অবশ্য দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁদেরকে ইংরেজ প্রশাসনের কোপানলের শিকার হয়ে থাকতে হয়েছিল। সশস্ত্র সংগ্রাম আপাত ব্যর্থ হলে তাঁরা নীরব ও সফল আন্দোলনের বীজ দেওবন্দের মাটিতে বপন করেন। যা ধীরে ধীরে গোটা ভারতবর্ষে আপন শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লব বিস্তার করে এক মহীরুহের রূপ ধারন করে। যার সুশীতল ছায়ায় ইসলাম ও মুসলিম জাতির ইহতহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাহযীব-তামাদ্দুন ও স্বাতন্ত্রবোধ লালিত হতে থাকে। হাঁ, সেই ‘সাজারে তুবা‘র নাম ‘দরুল উলুম‘ ।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- তদানীন্তন হিন্দুস্তানে কোন দ্বীনি মারকায প্রতিষ্ঠা করা ছিল নিজেকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেবার নামান্তর। সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের শাসনামলে শুধুমাত্র দিল্লিদতই সহস্রাধিক মাদরাসা ছিল। কিন্তু ফিরিঙ্গি আগ্রাসনের পর পুরো ভারতবর্ষের কোথাও একটি মাদরাসা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। ওলামায়ে কেরামকে আযাদী আন্দোলনে অংশ গ্রহণের অপরাধে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হত কিংবা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হত।

আর যারা মুক্ত ছিলেন, সংঘবদ্ধ হওয়া তাদের জন্য ছিল দুষ্কর। তাই আকাবিরত্রয় প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রামকেই বেছে নিয়ে প্রভুত কল্যাণের এই ধারা রচনা করেন। কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- ১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরী মোতাবেক ৩০ মে ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে নিতান্ত অনাড়ম্বর এক অনুষ্টানে এই নীরব আন্দোলন প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এখলাসের সাথে দ্বীনের খেদমতই যেহেতু একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল তাই কোন প্রচার মাধ্যমের আশ্রয় না নিয়ে দেওবন্দের ছোট্র পল্লিতে, ছাত্তা মসজিদের আঙ্গিনায়, একটি ডালিম গাছের ছায়ায়, আবে হায়াতের এই নহর তারা রচনা করেন।

দুই বুযুর্গের মাধ্যমে কার্যত প্রতিষ্ঠানটির পদযাত্রা শুরু হয়। প্রথমজন শিক্ষক; হযরত মাওলানা মোল্লা মাহমুদ। দ্বিতীয়জন ছাত্র; দেওবন্দের নওজোয়ান মাহমুদ হাসান। যিনি পরবর্তীতে শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান নামে খ্যাত হন। এবং ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- লর্ড ম্যাকল কর্তৃক ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়ার হীন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতঃ দ্বীনকে অক্ষুন্ন রাখা ছিল দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য।

এরই সাথে ওলামায়ে কেরামের এক জানবাজ জামাত তৈরি করাও ছিল সময়ের দাবী, যারা যে কোন পরিস্থিতিতে দ্বীনকে আগলে রাখবেন এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে পৌছে দিবেন। যেন সাধারণ মানুষ ইসলামের হেদায়েত অনুসারে জীবন যাপন ও তার আলোকে নিজ ভবিষ্যত গড়তে পারে। কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- যদি বলা হয় ‘দারুল উলূম‘ নিজস্ব পরিমণ্ডলে সফল, তাহলে অতুক্তি হবে না। প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্ন থেকে তালীম তরবিয়ত, তাযকীয়া-তাসাউফ, দাওয়াত-সিয়াসত সহ প্রতিটি অঙ্গনের জন্য সে জন্ম দিয়ে আসছে যুগের খ্যাতনামা মনীষীবর্গকে।

যারা দ্বীনকে আগলে রেখেছেন অক্ষুন্ন আদলে। তার অমিয় বাণী পৌছে দিয়ে যাচ্ছেন উম্মাহর প্রতিটি ব্যক্তির কানে। আহারে-অনাহারে, দুঃখে-সাচ্ছন্দ্যে যে কোন প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে, আপন স্বার্থকে পেছনে ফেলে উম্মতের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে তারা নিবেদিত প্রাণ। বাতিলের শত ঝড় ঝাপটার মুখে হিমালয়ের মত অবিচল, তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সমুদ্র তরঙ্গের ন্যয় উত্তাল, নববী আদর্শের মূর্ত প্রতিক। কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- এ দেশের ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগারের এক সুগভীর চক্রান্ত নতুনভাবে শুরু হয়েছে।

এ চক্রান্তের নেটওয়ার্ক সুবিস্তৃত ও সুসংগঠিত। আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তি হচ্ছে এ চক্রান্তের মূল। তাদের বৃত্তিভোগী এজেন্টরা সুকৌশলে কুর’আন ও হাদীসের শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। এসব এজেন্টরা সরকারের অভ্যন্তরে, বিরোধী দলে, প্রশাসনে, বেসরকারী সেবা সংস্থায়, সংবাদপত্রে ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমানভাবে সক্রিয় থেকে অভিন্ন ভাষায় কথা বলছেন এবং একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নানা অজুহাত খাড়া করে। এনজিও সমর্থিত বেশ ক‘টি সংবাদপত্র তিলকে তাল করে এবং তালগোল পাকিয়ে তথ্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, যাতে জনমত বিভ্রান্ত হচ্ছে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এনজিওগুলো প্রকৃত অর্থে কোনো সরকারেরই বন্ধু নয়; সরকারকে ব্যবহার করে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাই হচ্ছে তাদের কর্মকৌশল। ভোলার গ্রীন ক্রিসেন্ট এনজিও প্রতিষ্ঠানকে কওমী মাদরাসা নামে প্রতিষ্ঠিত করার যে আয়োজন চলেছিল তা ছিল একই ষড়যন্ত্রের অংশ বিশেষ। ব্রিটেনের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত গ্রীন ক্রিসেন্ট এনজিও কার্যালয় যে আদৌ কোন কওমী মাদরাসা নয় এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। সরকার, সরকারী এজেন্সীসমূহ যে কোন দিন, যে কোন সময়, বাংলাদেশের যে কোন কওমী মাদরাসা পরিদর্শন করতে পারেন, তাদের সার্বিক কর্মকান্ডও মনিটর করতে পারেন। কেবল এক শ্রেণীর বিদ্বিষ্ট সংবাদপত্রের কল্পিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কওমী মাদ্রাসাকে টার্গেট করলে সরকার ও জনগণের মধ্যে অহেতুক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাবে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর পরই উত্তর ভারতের দেওবন্দ কেন্দ্রিক যে দ্বীনি শিক্ষাধারা চালু হয়েছিল এখন তা এ উপমহাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা নামে বেশ সুখ্যাতি লাভ করে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই এ শিক্ষা ধারার উদ্দেশ্য ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার, জান্নাতমুখী জনগোষ্ঠী তৈরীকরণ, সামাজিক কুসংস্কার ও কুপমন্ডুকতা বিদূরিকরণ ও ব্যক্তি চরিত্র সংশোধন।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- প্রচলিত ও দলীয় রাজনীতির প্রভাব বলয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে কওমী মাদরাসার পরিচালক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফিক্হ, ভাষা-সাহিত্য, ক্লাসিক্যাল দর্শনের শিক্ষা ও খিদমত সুচারূরূপে আঞ্জাম দিয়ে আসছেন শত বছর ধরে। বাংলাদেশের বিগত ৩৮ বছরের ইতিহাসে কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোন কর্মকান্ডে বা সন্ত্রাসী কোন তৎপরতার সাথে জড়িত থাকার কোন প্রমাণ নেই।

কওমী মাদরাসা শিক্ষার সুদীর্ঘ ইতিহাসে খুন-খারাবী, টেন্ডার বা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের ন্যুনতম কোন নজির নেই। এসব মাদরাসায় রাজনীতিভিত্তিক কোন ছাত্র সংসদ নেই এবং ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততাও একপ্রকার নিষিদ্ধ। ফলে এখানে বিরাজ করে রাজনীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সুষ্ঠু শিক্ষার শান্ত পরিবেশ। সুতরাং মাদরাসায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পরিকল্পনার প্রশ্নই অবান্তর। আর সন্ত্রাসের আওতায় পড়ে এমন ঘটনা কোথাও ঘটলে তা নিশ্চিতভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই দায়ী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ যদি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে এবং অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের চেষ্টা চালায়, সে দায় কোন মাদরাসা নিতে পারে না।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- এ ক্ষেত্রে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বা সব মাদরাসাকে ঢালাওভাবে দায়ী করাও যুক্তি সংগত নয়। সত্যিকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ অবদমনে সরকারকে সহযোগিতা করতে এ দেশের ওলামা-মাশায়েখগণ সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত বলেই বার বার প্রমাণিত। স্মর্তব্য যে, কওমী মাদরাসারসমূহ পরিচালিত হয় মূলত এ দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অর্থায়নে; সরকারী কোন অনুদান তাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে গ্রহণ করেন না। এদেশের কোটি কোটি জনগণের সাথে কওমী মাদরাসার প্রাণের সম্পর্ক বিদ্যমান। কওমী মাদরাসা থেকে পাশ করা ছাত্ররা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরাপের সরকারী-বেসরকারী পদে, মসজিদ, মাদরাসা পরিচালনায়, দাওয়াত-তাবলীগে, সমাজ সংস্কারে, নিরক্ষরতা দূরিকরণে এবং শিক্ষা বিস্তারে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখে চলেছেন।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা ঈমানী চেতনা, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও দেশপ্রেমের আদর্শে প্রবলভাবে উদ্দীপিত। দাওয়াতী মেযাজ সবার মধ্যে কমবেশী ক্রিয়াশীল। আমার ব্যক্তিগত প্রবল অনুমান যে, বর্তমান সরকার ও কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৃতীয় একটি শক্তি সক্রিয়। প্রকাশ্য ও নেপথ্য চক্রান্তের মূল হোতা হচ্ছে এক শ্রেণীর এনজিও। তারা সমান্তরাল একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় এবং বিনষ্ট করতে চায় সরকারের ভাবমূর্তি, কারণ এনজিওগুলো এদেশের এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত হলেও তাদের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ইহুদি-খ্রিষ্টান-সাম্রাজ্যবাদী অক্ষ শক্তি। এ দেশের মানুষ ভালভাবে জানেন যে, মাদরাসায় চরিত্রবান ও আদর্শ ছাত্র তৈরী হয়। মাদ্রাসায় শিক্ষার সাথে দীক্ষার (তারবিয়ত) ব্যবস্থা আছে, যা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকায় কোন ছাত্রসংসদ নেই। ফলে সংগত কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে হানাহানিও নেই। রাজনৈতিক হাঙ্গামা বা সন্ত্রাসের কারণে এদেশের কোন মাদরাসা একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি। অথচ এদেশের হাতেগোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কমবেশি সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মিনি ক্যান্টনমেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন সময় বন্ধ থাকায় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট সৃষ্টি এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হাজারো টগবগে মেধাবী তরুণ নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ধর্ষণ জাতির কপালে কলংকের তিলক রেখা অংকিত করেছে। সামপ্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যেভাবে অস্ত্রের মহড়া চললো এবং প্রাণহানি ঘটলো তাতে পুরো জাতি উদ্বিগ্ন হয়েছে। এতদসত্ত্বেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কোন দাবি কেউ উঠায়টি।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- তাই সাজানো কিছু নাটক, পাতানো কিছু খেলা ও কল্পিত তথ্যকে ভিত্তি করে কিংবা অতি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনার সূত্র ধরে মাদরাসা বন্ধের দাবি তোলা রীতিমত হাস্যকর ও উদ্ভট। এদেশে দ্বীনি শিক্ষার বিরুদ্ধে যে চক্রটি সক্রিয়, বিশেষত এনজিও গোষ্ঠী, তারা তাদের এজেন্টদের সহায়তায় এবং নিজস্ব সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারকে প্ররোচিত করছে, যাতে সরকার মাদরাসার বিরুদ্ধে দমননীতি জোরদার করে এবং নেতিবাচক সিদ্ধান- গ্রহণ করে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে বা নীতি নির্ধারক মহলে এনজিও সমর্থক যেমন আছেন, তেমনি দ্বীনি শিক্ষাকে মোহাব্বত করেন এমন ব্যক্তিরও আশা করি অভাব নেই। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার প্রকৃত সত্য অনুধাবন এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেন্টিমেন্ট ও আবেগের দিকে লক্ষ্য রেখে দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষার পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। কারণ এটা বুমেরাং হওয়ার আশংকা আছে। দ্বীনি শিক্ষার বিকাশধারায় সরকার যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন অবদান রাখতে পারেন, তাহলে এটা হবে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদীদেরকে মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রাখার সুযোগ দিলে পরিস্থিতি আক্ষেপ, ক্ষোভ ও বেদনার মিলিত সংকট মোহনায় চলে যেতে পারে, এমন আশংকা অমূলক নয়।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ইস্যুর মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে অকার্যকর এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করার খেলায় মেতে উঠেছে, এ কথাটি সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতার চেতনাকে দৃঢ়ভাবে লালনের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাই সত্যিকারের মানুষ গড়ে তোলার আদর্শ শিক্ষাঙ্গন। মাদরাসাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ব পালন, ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়া হয়।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- নৈতিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে সুনাগরিক উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসাগুলোর রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। বর্তমানে কওমী মাদরাসার ওপর যে সব বহুমূখি বিষোদগার হচ্ছে তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন গোটা দেশ জুড়ে প্রতিনিধিত্বশীল কওমী মাদরাসার একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যে প্লাটফরমের মাধ্যমে নিয়মিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সংলাপ, কর্মশালা করে নিজেদের অবস্থান জনসমক্ষে তুলে ধরা যেতে পারে। এতে এ বিষয়ক অজ্ঞতা ও বিভ্রানি- যেমন দূর হবে তেমনি আন্তরিকতা বাড়বে। সামাজিক ও সেবামূলক বিভিন্ন প্রোগ্রামে মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের সংযুক্তি বাড়াতে হবে। স্থানীয় ছোট ছোট বৈধ উপলক্ষগুলোতেও মাদরাসার পক্ষ থেকে ইতিবাচক অংশগ্রহণ বজায় রাখার প্রতি মনোযোগী হতে হবে।

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ: কিছু কথকতা:- আধুনিক শিক্ষিত ও সাধারণ জনগণকে এ সংগঠনের মাধ্যমে অথবা ব্যক্তিগত যোগাযোগ দ্বারা কওমী মাদরাসার প্রতি আরো সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলা যাবে। সুচিন্তিত পন্থায় এসব প্রোগ্রামের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন স্বার্থান্বেষী মহল রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হবে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রকার যোগাযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং বাড়িয়ে তুলতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে বহু দ্বীন দরদী ব্যক্তি আছেন যারা আলেম-উলামা ও মাদ্রাসাকে মুহাব্বত করেন; কিন্তু যোগাযোগের অভাবে গ্যাপ তৈরী হয়ে আছে। এ গ্যাপ যত তাড়াতাড়ি দূর করা সম্ভব হবে ততই মঙ্গল। ইতিবাচক সব কাজ ও লক্ষ্যের সঙ্গে মিডিয়াও কিছুটা অনূকুলে থাকলে আগ্রাসীদের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া ইনশাআল্লাহ কোনো কঠিন ব্যাপার হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *