নবী যুগে হাদীস লিখন: চুক্তি, সন্ধিপত্র ও লিখিত ফরমান

95 / 100

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

নবী যুগে হাদীস লিখন

১. মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের অধিবাসীদের জন্য লিখিত সনদ

নবী যুগে হাদীস লিখন

নবী যুগে হাদীস লিখন: হিজরতের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি নীতিমালা লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন, যা এখন ‘মদীনা-সনদ নামে পরিচিত। এতে মুহাজির ও আনসারীগণের দায়িত্ব ও অধিকার, মদীনা ও আশপাশের আরব ও ইহুদী কবীলাসমূহের সঙ্গে মিত্রতা এবং নাগরিক ও সামাজিক বিধানাবলি উল্লেখিত হয়েছিল। এই দলীলের বিভিন্ন অংশ হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে।

(দেখুন : সহীহ মুসলিম হাদীস ১৭/১৫০৭; সুনানে নাসাঈ হাদীস ৪৮২৯; মুসনাদে আহমদ ১/২৭১, হাদীস ২৪৩৯, ২৪৪০) পূর্ণ দলীলটিও সংরক্ষিত আছে হাদীস, সীরাত ও তারীখের বিভিন্ন গ্রন্থে। দেখুন : আলআমওয়াল, আবু উবায়দ পৃ. ২৬০; সীরাতে ইবনে হিশাম (আররওযুল উনুফ) ৪/২৪০-২৪৩; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৬১৯-৬২২ (হিজরী প্রথম বর্ষের ঘটনাবলি)

২. হুদায়বিয়ার সন্ধি

৬ষ্ঠ হিজরীর যিলকদ মাসে এই সন্ধি লিপিবদ্ধ হয়েছিল। এর বিভিন্ন অংশ সহীহ বুখারীসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।

দেখুন : সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪২৫১, ২৬৯৮, ২৬৯৯, ২৭৩১, ২৭৩২ পূর্ণ সন্ধিপত্রটির জন্য দেখুন : সীরাতে ইবনে হিশাম (আররওযুল উনুফ) ৬/৪৬২-৪৬৪; মুসনাদে আহমদ ৪/৩২৫, ৩২৮-৩৩১; তাফসীরে তবারী ১১/৩৫৮ (সূরা ফাত্হ)

৩. নাজরানবাসীকে প্রদত্ত ফরমান

এতে নাজরানবাসী ঈসায়ীদের উপর তাদের সকল শস্য ও সম্পদের বিপরীতে নির্ধারিত জিয্য়া আরোপ করা হয় এবং তাদের জান-মাল ও উপাসনালয়ের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ও তাতে রয়েছে।

পূর্ণ দলীলটির জন্য দেখুন : কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসুফ পৃ. ৪১; কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়দ পৃ. ২৪৪-২৪৭

৪. আয়লাবাসীকে প্রদত্ত ফরমান

তাবুকের নিকটবর্তী একটি প্রাচীন জনপদ আয়লা। নবম হিজরীতে তবুক-অভিযানে আয়লার শাসক ইউহান্না ইবনে রূবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য স্বীকার করে জিয্য়া প্রদানে সম্মত হন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, সেসময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি লিখিত দলীল প্রদান করেছিলেন।

নবী যুগে হাদীস লিখন: দেখুন : সহীহ বুখারী হাদীস ১৪৮১; ৩১৬১; সহীহ মুসলিম হাদীস ১৩৯২/১১-১২; মুসনাদে আহমদ হাদীস ২৩৬০৪ এতে আয়লাবাসীর জন্য নিরাপত্তার ফরমান এবং তাদের কর্তব্য ও অধিকার উল্লেখিত হয়। পূর্ণ দলীলটির জন্য দেখুন : সীরাতে ইবনে হিশাম (আররওযুল উনুফ) ৭/৩১৭; আলআমওয়াল, আবু উবায়দ পৃ. ৫১৩

তদ্রূপ ইসলাম গ্রহণকারী বহু কবীলাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখিত দলীল প্রদান করেছিলেন। এসব দলীলে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে ‘আমান’ ও ‘যিম্মা’ লিপিবদ্ধ থাকত। হাদীসের কিতাব থেকে একটি নমুনা পেশ করছি। আবুল আ’লা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনুশ শিখখীর রা. বলেন, ‘আমরা (বসরার) মির্বাদ নামক স্থানে ছিলাম। আমাদের কাছে একজন বেদুঈন এল। তার কাছে ছিল এক খণ্ড চামড়া। সে তা বের করে বলল, তোমাদের কেউ কি এই দলীলটি পাঠ করে শোনাতে পারে? তাতে লিখিত ছিল-

নবী যুগে হাদীস লিখন

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

নবী যুগে হাদীস লিখন: মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে উকল-এর বনু যুহাইর ইবনে উকাইশ এর জন্য। তোমরা যদি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং নামায আদায় কর, যাকাত প্রদান কর, মুশরিকদের থেকে দূরে থাক, গনীমতের মাল থেকে এক পঞ্চমাংশ ও নবীর অংশ প্রদান কর তাহলে তোমাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে আমান (নিরাপত্তা)।-মুসনাদে আহমদ ৫/৭৭-৭৮; ৩৬৩; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ২৯৯২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৩৭৭৯০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৮৭৭; আল-আমওয়াল, আবু উবায়দ হাদীস ৩০; মুনাতাকা ইবনুল জারূদ ১০৯৯

নবী যুগে হাদীস লিখন: নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-গ্রন্থ ও জীবনী-গ্রন্থেও এরূপ অনেক দলীলের বিবরণ রয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত : ৭. দু’মাতুল জান্দালের গোত্রপতি উকাইদির ইবনে আবদুল মালিককে একটি লিখিত ফরমান প্রদান করা হয়েছিল।-ইসাবা ১/২৪৫ ইমাম আবু উবায়দ কাসিম ইবনে সাল্লাম রাহ. বলেন, ‘একজন শায়খ আমার নিকটে এই দলীলটি নিয়ে এসেছিলেন। আমি তা পাঠ করেছি এবং হুবহু নকল করেছি। দলীলটি সাদা চামড়ায় লিখিত ছিল।

দেখুন : আল আমওয়াল ২৫২-২৫৩ ৮. কবীলায়ে ত্বইকে একাধিক ফরমান প্রেরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। জীবনীকারগণ আমির ইবনুল আসওয়াদ ত্বয়ী রা.-এর আলোচনায় একটি দলীলের কথা উল্লেখ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে যে, ভূমি ও পানির উপর তার ও তার কওমের অধিকার বহাল থাকবে যে পর্যন্ত তারা নামায আদায় করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং মুশরিকদের মিত্রতা থেকে বর্জন করবে।

নবী যুগে হাদীস লিখন: দেখুন : উসদুল গাবাহ ২/৫১০; আল-ইসাবা ৩/৫৭৬ ৯. সইফী ইবনে আমির রা.-এর জীবনীতে একটি লিখিত দলীলের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে তার আমীর নিযুক্তির ফরমান ও কবীলার মুসলিমদের জন্য নিরাপত্তার ঘোষণা ছিল। তাতে সালাত ও যাকাত আদায় করা এবং গনীমতের নির্ধারিত অংশ প্রেরণের বিধান ছিল। -আল-ইসতীআব ২/৭৩৪; উসদুল গাবাহ ২/৪৬৪; আল-ইসাবা ৩/৪৫৩ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-গ্রন্থ ও জীবনী গ্রন্থে এ ধরনের অনেক সন্ধিনামা ও আমাননামার নমুনা বিদ্যমান রয়েছে।

রসূল (ﷺ) হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন- সকল মুসলিমের অঙ্গিকার ও নিরাপত্তা একই রকম। তাদের সবচেয়ে কম মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির অঙ্গিকার এবং নিরাপত্তা প্রদানও পূর্ণ করতে হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের নিরাপত্তা সম্পর্কিত চুক্তি ভঙ্গ করবে, তার উপর আল্লাহ্, ফিরিস্তা এবং সমস্ত মানুষের লা’নত। আল্লাহ্ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার ফরয বা নফল কোন ইবাদতই কবুল করবেন না। তিনি আরও বলেন- কোন ব্যক্তি এবং কোন গোত্রের মধ্যে যদি চুক্তি থাকে, তাহলে সেই চুক্তি যেন ভঙ্গ না হয়। তবে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে সেই অঙ্গিকার ভঙ্গ করতে পারে।

আর কোন পক্ষ চুক্তির অবসান চাইলে অপর পক্ষকে জানিয়ে দিতে হবে। যাতে উভয় পক্ষই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টি সমানভাবে জানতে পারে। নাবী (ﷺ) আরও বলেন- যে ব্যক্তি কোন মানুষকে জানের নিরাপত্তা দেয়ার পর হত্যা করবে, আমি তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাঁর থেকে আরও বর্ণনা করা হয় যে, যখনই কোন সম্প্রদায় অঙ্গিকার ভঙ্গ করবে, তখন তাদের উপর শত্রুকে সবল করে দেয়া হবে। নবী যুগে হাদীস লিখন:

নবী যুগে হাদীস লিখন: নবী (ﷺ) যখন হিজরত করে মদ্বীনায় আসলেন, তখন মদ্বীনার কাফেররা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গেল।

  • একটি দল নাবী (ﷺ) এর সাথে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হল যে, তারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেনা, তাঁর বিরুদ্ধে কোন প্রকার হামলা করবেনা এবং তাঁর শত্রুকে তার বিরুদ্ধে সাহায্যও করবেনা। তারা কুফরীসহ তাদের জান ও মাল নিয়ে মদ্বীনায় নিরাপদে বসবাস করবে।
  • একদল তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল এবং তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করল।
  • আরেক প্রকার কাফের তাঁর সাথে কোন প্রকার চুক্তি করলনা এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করলনা। তারা তাঁর এবং তাঁর শত্রুদের শেষ পরিণামের অপেক্ষায় থাকল। তবে এই দলের কেউ কেউ মনে মনে তাঁর বিজয় কামনা করত। আবার এদের কেউ তাঁর শত্রুদের বিজয় কামনা করত। এদের মধ্যে আরেক গ্রম্নপ ছিল, যারা প্রকাশ্যভাবে ইসলামে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু গোপনে তারা তাঁর শত্রুদের সাথেই ছিল। যাতে তারা উভয় দলের ক্ষতি হতে নিরাপদ থাকতে পারে। এরাই ছিল মুনাফিক। রসূল (ﷺ) এ সমস্ত কাফেরদের সাথে হুকমে ইলাহী অনুযায়ী কাজকারবার করেছেন।

সুতরাং তিনি মদ্বীনার ইহুদীদের সাথে সন্ধি চুক্তি করলেন এবং তাদের সাথে নিরাপত্তার সনদ রচনা করলেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধের পর বনু কায়নুকা নাবী (ﷺ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল। কেননা বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়কে তারা ভাল চোখে দেখেনি। তাই তারা হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা প্রকাশ করে চুক্তি ভঙ্গ করল।

অতঃপর বনী নযীরের ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করল। তাই তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন এবং তাদেরকে ঘেরাও করলেন ও তাদের খেজুর বৃক্ষগুলো কেটে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। অতঃপর নাবী (ﷺ) তাদেরকে মদ্বীনা হতে এই শর্তে বের হয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন যে, তারা যুদ্ধাস্ত্র ব্যতীত উট বোঝাই করে অন্যান্য আসবাব-পত্র সাথে নিয়ে যেতে পারবে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এই কাহিনী সূরা হাশরে উল্লেখ করেছেন।

এরপর বনী কুরায়যার ইহুদীরা অঙ্গিকার ভঙ্গ করল। এরা রসূল (ﷺ) এর ঘোর বিরোধী ছিল এবং কুফরীতে ছিল খুবই মজবুত। এ জন্যই অন্যান্য ইহুদীর তুলনায় এদের বিরুদ্ধে কঠিনতম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

এই ছিল মদ্বীনার ইহুদীদের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যবস্থা। তিনি প্রত্যেকটি বড় যুদ্ধের পরপরই ইহুদীদের একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। বদরের যুদ্ধের পর বনু কায়নুকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, উহুদের পর বনু নযীরের বিরুদ্ধে এবং খন্দকের পরে বনী কুরায়যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আর খায়বারের ইহুদীদের আলোচনা একটু পরেই আসছে।

তাঁর পবিত্র সুন্নত এই ছিল যে, তিনি যখন কোন গোত্রের সাথে চুক্তি করতেন, তখন তাদের কতক লোক যদি সেই চুক্তি ভঙ্গ করত আর কতক লোক সেই চুক্তি বহাল রাখত এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকত, তাহলে সকলের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতেন। যেমন তিনি করেছিলেন বনী কুরায়যা, বনী নযীর এবং মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে। এই ছিল চুক্তিবদ্ধ কাফেরদের বিরুদ্ধে নবী (ﷺ) এর পবিত্র সুন্নত।

নবী যুগে হাদীস লিখন: ইমাম আহমদ এবং অন্যান্য ইমামদের মতে যিম্মীদের ব্যাপারেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।[1] ইমাম শাফেঈর ছাত্রগণ এই মতের খেলাফ করেছেন। তারা বলেন, যারা চুক্তি ভঙ্গ করবে, কেবল তাদের সাথে তা ভঙ্গ করা যাবে, অন্যদের সাথে নয়। যারা অঙ্গিকার রক্ষা করবে তাদের সাথে অঙ্গিকার রক্ষা করা জরুরী। শাফেঈগণ উভয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে বলেন যে, অঙ্গিকারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রথম মতটিই অধিক বিশুদ্ধ।

নবী যুগে হাদীস লিখন:

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন- যখন সিরিয়ার খৃষ্টানরা মুসলমানদের সম্পদ ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল, তখন অন্যান্য খৃষ্টানরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েও মুসলিম শাসককে জানায়নি; বরং তারা খৃষ্টানদের কাজকেই সমর্থন করল। কিন্তু শাসক বিষয়টি জানতে পেরে আলেমদের কাছে যখন ফতোয়া চাইলেন, তখন আমরা ঐ খেয়ানতকারীদের ব্যাপারে শাসককে ফতোয়া দিলাম যে, যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে, যারা এতে সহায়তা করেছে এবং যারা এতে সন্তুষ্ট হয়েছে এদের সকলকেই হত্যা করতে হবে। এদের ব্যাপারটি শাসকের ইচ্ছাধীন নয়, হত্যাই একমাত্র তাদের শাস্তি।

ইসলামের বিধিবিধান মেনে নিয়ে যে সমস্ত যিম্মী নিরাপত্তার অঙ্গিকার নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করবে, তারা যদি এমন কোন অপরাধ করে, যার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড, তাহলে ইসলাম তাকে মৃত্যুদন্ড হতে রেহাই দিবেনা। কিন্তু হারবী তথা যুদ্ধরত কোন কাফের যদি ইসলাম কবুল করে নেয়, তাহলে তার হুকুম সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ তখন তাকে হত্যা করা যাবেনা। চুক্তি ভঙ্গকারী যিম্মীর হুকুম আলাদা। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের উক্তি হতে এটিই সুস্পষ্ট হয়েছে। আমাদের শাইখ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) অনেক স্থানেই এই ফতোয়া দিয়েছেন।

নবী (ﷺ) যখন কোন গোত্রের সাথে চুক্তি করতেন, তখন তাদের সাথে তাঁর অন্যান্য শত্রুরাও শরীক হত। তাঁর সাথেও অন্য কাফেররা এসে যোগ দিত। এতে করে যারা তাঁর সাথে যোগদানকারী কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত তাদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে বলেই ধরে নেওয়া হত। এই কারণেই তিনি মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। কেননা হুদায়বিয়ার সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং কুরাইশদের মধ্যে দশ বছর পর্যন্ত সকল প্রকার যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই চুক্তিতে বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে যোগ দিল। আর খোযাআ গোত্র যোগ দিল রসূল (ﷺ) এর সাথে।

পরবর্তীতে বনু বকর গোত্র রাতের অন্ধকারে খুযাআ গোত্রের উপর ঝাপিয়ে পড়ল এবং তাদের কতককে হত্যা করল। কুরাইশরাও গোপনে বনু বকরকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল। তাই নাবী (ﷺ) মক্কার কুরাইশদেরকে অঙ্গিকার ও চুক্তি ভঙ্গকারী হিসাবে গণনা করলেন এবং বনু বকর ও কুরাইশদের বিরুদ্ধে হামলা করে মক্কা জয় করলেন।

এ কারণেই শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) পূর্বাঞ্চলের খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ফতোয়া দিয়েছিলেন। কারণ তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাতারদেরকে সাহায্য করেছিল এবং অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইন্ধন যুগিয়ে ছিল। এ জন্যই তাদেরকে চুক্তি ভঙ্গকারী হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী যিম্মীরা যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বহিরসূত মুশরিকদেরকে সাহায্য করে তাহলে তাদেরকে চুক্তি ভঙ্গকারী এবং বিদ্রোহ ঘোষণাকারী সাব্যস্ত করা হবে না কেন?

নাবী (ﷺ) এর কাছে তাঁর শত্রুদের দূতগণ আগমণ করত। তাঁর প্রতি তাদের শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও তিনি দূতদেরকে কোন প্রকার কষ্ট দিতেন না। যখন মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার মুসায়লামা কাজ্জাবের পক্ষ হতে দু’জন প্রতিনিধি রসূল (ﷺ) এর দরবারে আগমণ করল তখন রসূল (ﷺ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- মুসায়লামার ব্যাপারে তোমাদের আকীদাহ (বিশ্বাস) কী? তারা বলল- সে যেমন দাবী করে তেমনই। তখন রসূল (ﷺ) বললেন- দূতগণকে হত্যা করা যদি দোষণীয় না হত তাহলে আমি তোমাদেরকে হত্যা করতাম। এখান থেকেই দূতদেরকে হত্যা না করার সুন্নত জারী হল।

তাঁর পবিত্র সুন্নত এই ছিল যে, অমুসলিমদের কোন দূত যদি তাঁর কাছে এসে ইসলাম কবুল করত, তাহলে তিনি তাকে রেখে দিতেন না; বরং প্রেরকের নিকট ফেরত পাঠাতেন। যেমন আবু রাফে (রাঃ) বলেন- মক্কার কুরাইশরা আমাকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট পাঠাল। আমি যখন তাঁর নিকট হাজির হলাম তখন আমার অন্তরে ইসলামের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত হল। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমি ফেরত যেতে চাইনা। রসূল (ﷺ) তখন বললেন- আমি অঙ্গিকার ভঙ্গ করিনা এবং দূতগণকে আটকিয়ে রাখিনা। তুমি তাদের কাছে ফেরত যাও। সেখানে যাওয়ার পরেও যদি তোমার অন্তরে ইসলামের প্রতি ভালবাসা অনুভব হয়, তাহলে পুনরায় ফেরত এসো।

নবী যুগে হাদীস লিখন: ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) বলেন- এটি ছিল ঐ সময়ের ঘটনা যখন নাবী (ﷺ) ও কুরাইশদের মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি চলছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল, মক্কাবাসী কোন লোক মুসলমান হয়ে মদ্বীনায় আসলে তাকে মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এরূপ করা যাবেনা। রসূল (ﷺ)-এর বাণী, ‘আমি দূতকে আটকিয়ে রাখিনা’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি। মুসলমান হয়ে কেউ আসলে তাঁকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারটি শর্তের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রীয় দূতদের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা।

নবী যুগে হাদীস লিখন:

তাঁর অনুমতি ছাড়াই কোন একজন সাহাবীর সাথে তাঁর শত্রুরা যদি এমন কোন চুক্তি করত, যাতে মুসলমানদের ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই, তাহলে তিনি সেই চুক্তি ও অঙ্গিকার বহাল রাখতেন। যেমন হুযায়ফা ও তার পিতার সাথে শত্রুরা এই মর্মে চুক্তি ও অঙ্গিকার করেছিল যে, তোমরা দু’জন রসূল (ﷺ)-এর সাথে যোগ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবেনা। নাবী (ﷺ) এই অঙ্গিকার বহাল রাখলেন এবং হুযায়ফা ও তার পিতাকে বললেন- তোমরা ফেরত যাও। তারা তোমাদের সাথে যে অঙ্গিকার করেছে আমরা তা রক্ষা করব। আমরা তাদের মুকাবেলায় কেবল আল্লাহর সাহায্য চাই।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- তিনি কুরাইশদের সাথে দশ বছর মেয়াদী (যুদ্ধ বিরত থাকার) চুক্তি করলেন। তাতে এই শর্ত রাখা হয়েছিল যে, মক্কাবাসীদের কেউ যদি মুসলমান হয়ে তাঁর নিকট আগমণ করে তাহলে তাকে মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে। আর মদ্বীনার কেউ যদি মক্কায় আশ্রয় গ্রহণ করে মক্কাবাসীগণ তাকে ফেরত দিবেনা। চুক্তিতে নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণীই শামিল ছিল। পরবর্তীতে আল্লাহ্ তা‘আলা মহিলাদের বিষয়টি রহিত করে দিলেন এবং তাদেরকে পরীক্ষা করার আদেশ দিলেন। তাদেরকে মুমিন মহিলা হিসাবে জানা গেলে তাকে আর কাফেরদের নিকট ফেরত দেয়া হতনা। শুধু কাফেরের সাথে বিবাহের সময় ঐ নারীকে প্রদত্ত মোহরানা ফেরত দেয়া হত।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- আর কোন মুশরিকের স্ত্রী মুসলমান হয়ে মদ্বীনায় চলে আসলে তিনি মুসলিমদেরকে আদেশ দিতেন, তারা যেন সেই মহিলার বিবাহের মোহরানা তাঁর মুশরিক স্বামীকে ফেরত দেয়। সুতরাং তারা মুহাজির মুমিন মহিলার মোহরানা তার কাফের স্বামীর নিকট ফেরত পাঠাতেন। তাকে তার মুশরিক স্বামীর নিকট ফেরত পাঠানো হতনা। এ থেকে জানা যাচ্ছে যে, স্বামীর মালিকানা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে মহিলার পক্ষ হতে অবশ্যই মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আর সেটি হচ্ছে সেই মোহরানা, যা বিবাহের সময় নির্ধারিত হয়েছিল। মহরে মিছ্ল (মহিলার খালা বা ফুফুর জন্য সেই পরিমাণ মোহরানা নির্ধারিত হয়েছে তা) নয়। এ থেকে আরও জানা গেল যে, কাফেরদের বিবাহ-সাদীও বিশুদ্ধ এবং শর্তের মধ্যে লিখা থাকলেও হিজরতকারী মুসলিম মহিলাকে কাফেরদের নিকট ফেরত দেয়া যাবেনা।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- আরও জানা গেল যে, কোন মুসলিম নারীর জন্য অমুসলিম কাফেরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয নয় এবং ইদ্দত পার হয়ে যাওয়ার পর মোহরানা পরিশোধ করে হিজরতকারী মহিলাকে বিবাহ করা মুসলিম পুরুষের জন্য বৈধ।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- এতে আরও সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে যে, হিজরতের মাধ্যমেই স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার বৈবাহিক বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং স্ত্রীর উপর থেকে কাফের স্বামীর মালিকানা সম্পূর্ণরূপে উঠে যায়। মুশরিক মহিলাকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- উপরোক্ত বিধানগুলো কুরআনের আয়াত থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর উপর কতক আলেমদের ইজমাও সংঘটিত হয়েছে। আর কতক মাসআলায় আলেমদের মতবিরোধও রয়েছে। যারা বলে এগুলো রহিত হয়ে গেছে, তাদের কাছে কোন দলীল নেই।

কেননা নাবী (ﷺ) এবং মুশরিকদের মধ্যে যেই শর্ত ছিল, তাতে কেউ মুসলমান হয়ে মদ্বীনায় আসলে তাকে ফেরত দেয়ার কথা ছিল। তবে পুরুষদের সাথেই বিষয়টি সম্পৃক্ত ছিল। মহিলারা এই শর্তের আওতায় ছিলনা। তাই মুসলমান হয়ে কোন মহিলা চলে আসলে তাকে ফেরত দিতে নিষেধ করা হয়েছে।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- নবী (ﷺ) শুধু মোহরানা ফেরত দেয়ার আদেশ করেছেন। যার স্ত্রী মুসলমান হয়ে মদ্বীনায় চলে আসবে সে ঐ পরিমাণ মোহরানা ফেরত পাবে, যা সে তাঁকে বিবাহের সময় প্রদান করেছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, এটিই হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করেন। আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞান ও হিকমতের আলোকেই এই ফয়সালা প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে এই হুকুমের বিপরীতে অন্য কোন হুকুম নাযিল হয়নি।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- নবী (ﷺ) যখন কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি করলেন তখন তিনি কুরাইশদের জন্য এই সুযোগ দিয়ে রেখেছিলেন যে, তাদের নিকট থেকে যে তাঁর কাছে চলে আসবে তারা তাকে ফেরত নিতে পারবে, তবে তিনি কাউকে ফেরত যেতে বাধ্য করতেন না বা আদেশও দিতেন না। আর সেই আগত ব্যক্তি যখন কাউকে হত্যা করে ফেলত কিংবা কারও মাল ছিনতাই করে নিয়ে তার আয়ত্তের বাইরে চলে যেত এবং মুসলমানদের সাথেও এসে যোগ দিত না, তখন তিনি এর কোন প্রতিবাদ করতেন না এবং তার দ্বারা কৃত অপরাধের ক্ষতি পূরণ দেয়ার কোন দায়-দায়িত্ব বহন করতেন না। কারণ সে তার কর্তৃত্বাধীন ছিল না।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- তিনি তাকে ক্ষতি পূরণ দেয়ার হুকুমও দেন নি। কেননা জান ও মালের নিরাপত্তার ব্যাপারে নাবী (ﷺ) যেই চুক্তি তাদের সাথে করেছিলেন, তা কেবল তাঁর অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রনাধীন লোকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। যেমন তিনি বনী জুযায়মার ঐ সমস্ত জান ও মালের ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন, যা খালেদ বিন ওয়ালিদের হাতে নষ্ট হয়েছিল। সেই সাথে তিনি খালেদ বিন ওয়ালিদের কাজকর্মকে অপছন্দ করেছেন এবং তা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ঘোষণা করেছেন।

নবী যুগে হাদীস লিখন:- নবী (ﷺ) এর আদেশে খালেদ (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। আর খালেদ (রাঃ) যেহেতু তাবীল করে (ইজতেহাদ) করে এরূপ করেছিলেন, কারণ তারা সরসূরি এটি বলেনি যে, আমরা মুসলমান হয়ে গেছি; বরং তারা বলেছিল- আমরা সাবে হয়ে গেছি অর্থাৎ পূর্বের দ্বীন পরিত্যাগ করেছি। এ কারণেই খালেদ (রাঃ) তাদের ইসলামের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি তাবীল ও সন্দেহের কারণে তাদেরকে অর্ধেক দিয়ত দিয়েছিলেন। তাদের ক্ষেত্রে তিনি আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খৃষ্টানদের বিধান জারী করেছেন। কেননা তারা অঙ্গিকার ও চুক্তির ভিত্তিতে জান-মালের নিরাপত্তা পেয়েছিল; ইসলামের মাধ্যমে নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *